পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১২

এবং বাজার মৌলবাদের বেনোজলে নারী



Kaberi-Gaen-1মৌলবাদ বলতেই আমরা সাধারণভাবে ধর্মীয় মৌলবাদকে ধরে নেই। অথচ ধর্ম ছাড়াও আরো তিন ধরণের মৌলবাদের কথা বলেন জেনসেন (২০০৬)। তাঁর মতে, চার ধরণের মৌলবাদ রয়েছে পৃথিবীতে, যা যেকোন ধরণের গণতান্ত্রিক আবহকে নস্যাৎ করে দিতে পারে- ধর্মীয়, জাতীয়তাবাদী, অর্থনৈতিক এবং প্রাযুক্তিক। কর্পোরেট পুঁজিবাদ বা নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতিকে জেনসেন-এর মত তাত্ত্বিকরা ‘অর্থনৈতিক বা বাজার মৌলবাদ’ নামে আখ্যায়িত করছেন। ধর্মীয় মৌলবাদ যদিবা জনপরিসরে যথেষ্টই আলোচিত, যেমন ৯/১১ বা তালিবান রাজত্বে নারীর অবস্থান, কিন্তু কর্পোরেট পুঁজির দৌরাত্মের বিষয়টি একাডেমিক এবং বামপন্থীদের মধ্যেই খানিকটা আলোচিত হতে দেখা যায়, জনপরিসরে ততটা নয়। তবে এই আলোচনায় ঢোকার আগে মৌলবাদ বিষয়ে আমাদের বোঝাপড়াটা একটু ঝালিয়ে নেয়া দরকার।
‘মৌলবাদ’ জগতকে দেখার এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী
‘মৌলবাদ’ প্রত্যয়টিকে প্রথম ব্যবহৃত হতে দেখা যায় ১৯ শতকে খৃস্টান ধর্মের প্রটেস্টান্টদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলনকে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে। এসব আন্দোলন বাইবেলের মূল পাঠ কী হবে, সে বিষয়ে আক্ষরিক কিংবা ‘মূলগত’ (fundamental) ব্যাখ্যা দেবার ব্যাপারে সোচ্চার ছিলো। আজকের দিনে মৌলবাদের সংজ্ঞা অনেক বিস্তৃত অবয়ব পেয়েছে। বর্তমানে এ প্রত্যয়টি পৃথিবীর বিভিন্ন্ দেশে সেইসব আন্দোলন-সংগ্রামকে বোঝায় যারা ঐতিহ্যের নামে কিছু মূলগত আচরণে ফিরে যেতে চায়- হতে পারে সেটি ধর্মীয়, জাতীয়তাবাদী অথবা নৃতাত্ত্বিক। রাজনৈতিকভাবে প্রণোদিত এসব আদর্শের মৌলবাদি অবস্থানটি হলো রাজনীতির উপরে স্বর্গীয় বিধিব্যবস্থা, সর্বশক্তিমানের উপর পূর্ণ আস্থা, কিংবা নৈতিক বিধিবিধান বা দর্শন চাপিয়ে দিতে চাওয়া যাকে প্রশ্ন করা যাবে না। সেদিক থেকে রিড (২০০২) মনে করেন, মৌলবাদ মোটেই ঐতিহ্যে ফেরা নয়, বরং এক কল্পিত গৌরবময় অতীতকে ঘিরে ঐতিহ্যের একটি উত্তরাধুনিক, রক্ষণশীল পুনঃব্যাখ্যায় ফেরা। এবং আমরা যখন মৌলবাদ সম্পর্কে কথা বলি, তখন এই সত্যকে ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে মৌলবাদি রাজনৈতিক অচরণের মূলটি খুঁজে পাওয়া যাবে ‘সঠিক বিশ্বাস’ (orthodoxy) এবং ‘সঠিক আচরণ’ (orthopraxis)-কে ধারণ করার অতিরিক্ত দাবীর মধ্যে। আর এখানেই জেনসেন-এর মতো তাত্ত্বিকরা মৌলবাদকে কেবল ধর্মের বাড়াবাড়ি হিসাবে না দেখে যে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক/রাজনৈতিক/ধর্মতাত্ত্বিক অবস্থান হিসাবে দেখেন যা যুক্তির চেয়ে যে কোন বিশ্বাস-কাঠামোকেই নিরঙ্কুশ মনে করে। শুধু তাই নয়, ভয়ংকর হলো এই মৌলবাদ অন্য যে-কোন বিকল্প চিণ্হ পদ্ধতিকেই খারিজ করে দেয়। এভাবেই মৌলবাদ কেবল ধর্মের সাথে সম্পর্কিত নয় বরং জগতকে দেখার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী। মৌলবাদের এই সংজ্ঞা অনুযায়ী বুশের আস্ফালন, “তোমরা হয় আমাদের সাথে আছ, অথবা সন্ত্রাস মোকাবেলায় আমাদের বিপক্ষে আছ’ এবং ‘হয় দারুল হার্ব অথবা দারুল ইসলাম’-এর মধ্যে খুব কমই পার্থক্য রয়েছে।

কর্পোরেট বাজারকে কেন ‘মৌলবাদ’ বলছি? জেনসেন (২০০৬)-এর মতে, এখানে ধরে নেয়া হয় যে বাজারের সর্বোচ্চ ব্যবহার সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতাকে উন্মুক্ত করবে এবং ফলাফল হবে আরো ভালো পণ্য, আরো বেশি বিক্রি, আরো বেশি মুনাফা এবং এজন্য সবকিছুই বৈধ। এই প্রতিযোগিতার প্রভাব কার উপর কেমন পড়লো কিচ্ছু যায় আসে না। বর্তমানের তথাকথিত ‘মুক্ত বাণিজ্য’র আদর্শ এই নয়া-উদারনীতিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চায়। এই বাজার মৌলবাদে এটি প্রায় একটি বিশ্বাস হিসাবে ছড়িয়ে দেয়া হয় যে বাজারের অদৃশ্য হাত সবসময়ই ভালো ফলাফল বয়ে আনবে, কিছু যায় আসে না এর প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবনে কেমন হবে। অন্য কথায়, অর্থনৈতিক মৌলবাদে সিস্টেম কীভাবে কাজ করে সেটি উপেক্ষা করে কেবলই বাজার বিস্তারের বন্দনা এমন একটি জগতে নিয়ে যায় যে জনগণ নিজেদের বাস্তব বঞ্চনার অভিজ্ঞতাকে পর্যন্ত উপেক্ষা করতে শিখে ফেলে। বাজারের সকল প্রতিক্রিয়াকে অমোঘ হিসাবে মেনে নেয়। এভাবে ধনী-গরীবের ব্যবধান প্রশ্নাতীতভাবে বাড়তে থাকে, পৃথিবীজুড়ে এবং দেশে-দেশে, দেশের মধ্যে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ মানুষ দিনে এক ডলারের কম আয়ে বাস করে এবং দিনে দুই ডলারের কম আয় করে প্রায় অর্ধেক মানুষ।
বাজার মৌলবাদ কার্যত পুরুষতান্ত্রিক
পেইটম্যান (১৯৮৮) তাঁর দ্য সেক্সুয়াল কন্ট্রাক্ট -এ যুক্তি দিয়েছিলেন যে পুঁজিবাদ কার্যত পুরূষতন্ত্রের একটি রূপ। নারীবাদীদের অনেকেই বলেছেন পুঁজিবাদ এবং পিতৃতন্ত্র সম্পূর্ণ একদেহ না হলেও দুই-এর সম্পর্ক নিবিড়। হার্টম্যান (১৯৮১: ২১-২২) যুক্তি দিয়ে দেখান যে পুঁজি এবং পিতৃতন্ত্রের যৌথতায় নারীর অধঃস্থনতার আধুনিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। পেইটম্যান (১৯৮৮:১৩১)-এর মতে, পুঁজিবাদী চাকরীচুক্তি বিয়েচুক্তিতে নারীর অধঃস্থনতাকে ধরে নিয়েই আগায়। তাঁর নিজের ভাষায়, “বিয়ে-চুক্তি চাকরীচুক্তির মতো কোন বিষয় নয়; বরং চাকরী-চুক্তি বিয়েচুক্তি সম্পর্কে পূর্বানুমান করে নেয়। আর এভাবেই ‘শ্রমিক’ শব্দটির নির্মিতিতে ধরেই নেয়া হয় যে সে একজন পুরুষ, যার একজন স্ত্রী রয়েছেন যার দৈনন্দিন দেখভালের জন্য ব্যবস্থা তাকে করতে হয়। এভাবেই পুঁজিবাদ পুরুষতন্ত্রে খর্বিত হয়ে যায়।” তার যুক্তির পক্ষে উদাহরণ হিসাবে হার্টম্যান ১৯০৭ সালের হারভেস্ট জাজমেন্টের উলে­খ করেন। সেই বিচারে, অস্ট্রেলিয়ার ইন্ডাস্ট্রিয়াল আরবিট্রেশন কোর্টে বিচারপতি হিগিনস শ্রমিকের ন্যূনতম বৈধ মজুরী ঘোষণা করেছিলেন এবং ন্যূনতম বাঁচার মজুরী হিসাবে বিধান দিয়েছেন একজন আদক্ষ শ্রমিকের নিজেকে চালানো, তার স্ত্রী এবং তিনজন শিশুসন্তানকে গ্রহণযোগ্য সাচ্ছন্দ্যে চালানোর সমপরিমাণ অর্থ। সেই একই বিচারক ১৯১৮ সালে একজন নারী শ্রমিকের বেতন তার স্বামীর বেতনের ৫৪% নির্ধারণ করেছিলেন এবং বলেছিলেন এর চেয়ে যেনো কম না হয়। প্রবার্ট (১৯৮৯: ৯৮)-এর মতে, শ্রমিক ইউনিয়নগুলো বারবার কাজগুলোকে ‘পুরুষের কাজ’ বলে নামকরণে আবেদন জানিয়েছে। আমেরিকার উদাহরণ টেনে হার্টম্যান দেখান আমাদের, ‘পারিবারিক বেতন’-এর ধারণার মধ্যে পুরুষতন্ত্র এবং পুঁজিবাদের দ্বৈত অংশীদারিত্ব নিশ্চিত হয়েছে।

পেইটমানের (১৯৮৮:১৩৯) মতে, “শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস কোন সন্দেহের অবকাশ রাখে না যে, পারিবারিক বেতনকাঠামোর উপর জোরারোপ ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল যার মাধ্যমে পুরুষ নারীকে নানা ধরণের সবেতন কাজের এলাকা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছে এবং একই সাথে স্বামীকে ঘরে প্রভুর ভূমিকায় রাখাও নিশ্চিত করতে পেরেছে।” এটি করা প্রয়োজন হয়েছিলো কারণ পূঁজিবাদী চাকরীচুক্তিকে বিয়েচুক্তির উপর একটা সরাসরি হুমকি হিসাবে পুরুষতন্ত্র বিবেচনা করছিলো, বিশেষ করে বিরোধের জায়গাটি ছিলো নারীর শ্রমের উপর কার অধিকার নিরস্কুশ হবে? গ্রামীণ এবং শহুরে উভয় গার্হস্থ্যেই এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছিলো, কারণ এই ‘গার্হস্থ্য স্ত্রী-শ্রম’-এর উপর কর্তৃত্ব ছিলো পুরুষের। এই ‘গার্হস্থ্য স্ত্রী-শ্রম’ জ্যাকসনের (১৯৯২: ১৫৪-১৫৫) মতে, বিনিময় এবং ঘরের প্রয়োজন মেটানো উভয় ধরণের উৎপাদনেই নিয়োজিত থেকেছে।
যাইহোক, নারীশ্রমের উপর অধিকার প্রশ্নে পুরুষ এবং পূঁজিবাদীর মধ্যে সম্ভাব্য স্বার্থের দ্বন্ধটি অনেকটাই মিটিয়ে ফেলা সম্ভব হয়, ওয়ালবির (১৯৯০) মতে, যখন পুরুষতন্ত্র প্রাইভেট থেকে পাবলিক কাঠামোতে পরিবর্তিত হয় এবং শস্তা, লিঙ্গবিভাজিত, অ-কাঠামোবদ্ধ নারীশ্রমকে শোষণ করা সম্ভব হয়। ওয়ালবির ভাষায় (১৯৯০: ১৮৫), “পুঁজিবাদ এবং পিতৃতন্ত্রের মধ্যে দ্বন্ধের মূল জায়গাটি ছিলো কে নারীর শ্রমকে শোষণ করবে। একদিকে, পুঁজিবাদের প্রয়োজন শস্তা নারীশ্রম। অন্যদিকে, পুরুষতন্ত্রের প্রয়োজন গার্হস্থ্য নারীশ্রম। ফলে একটি বিকল্প পিতৃতান্ত্রিক কৌশল আবিস্কৃত হলো – নারীকে সবেতন চাকরীতে নেয়া হলো ঠিকই কিন্তু অল্প বেতনে।”
যখন আমরা ব্যক্তিগত শ্রম থেকে পাবলিক শ্রমে পরিবর্তিত হই তখন, ফোলব্রে এবং হার্টম্যান (১৯৮৯: ৯৩)-এর মতে, “নারী আর গার্হস্থ্য পরিসরে আবদ্ধ নয়, বরং তার সামনে থাকে পুরো সমাজ যেখানে সে ঘুরে বেড়ায় এবং বঞ্চনার শিকার হয়। এই আপোষ বিশেষ করে আধুনিক পুঁজিবাদের জন্য বিশেষ প্রয়োজন কেননা আধুনিক পূঁজিবাদের প্রয়োজন নমনীয় (flexible) শ্রমশক্তি। লিঙ্গ-বিভাজন, নারীর স্বল্পমজুরী, এবং অ-বাজারী কাজের প্রতি অমর্যাদা– এসবই হলো পুরুষতন্ত্র এবং পূঁজিবাদের মধ্যকার পরিপূরকতার উৎস।”
এমনকি জনসনের মতো সমালোচক যিনি কী না পেইটম্যানের দাবীকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন, তিনি (১৯৯৬) পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে বর্তমানে আমরা খুবই একটি লিঙ্গীয় বৈষম্যপূর্ণ পুঁজিবাদী সমাজে বাস করছি, এর মূল কারণ এই যে, বিভিন্ন শ্রেণী থেকে আগত পুরুষ একটি বিষয়কে নিশ্চিত করতে এককাট্টা আর তা হলো এই যে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো বজায় থাকুক এবং পুঁজিবাদের সাথে মিলেমিশে চলুক। তিনি এটিও মেনে নেন যে চলে আসা সম্পত্তি সম্পর্কের কারণে বেশীরভাগ পুঁজিপতিই পুরুষ এবং এই সম্পর্ক-কাঠামো নারীকে সম্পত্তির অধিকারী হতে বাধাগ্রস্ত করেছে।
পারিবারিক বেতন-কাঠামো আজ হয়তো আর সেভাবে নেই। তথাকথিত নয়া-উদারনৈতিক কালে, যখন নিয়োজিত পুঁজির মুনাফা সর্বোচ্চকরণই উদ্দেশ্য তখন কেন কোন পুঁজির মালিক সস্তাশ্রমের জন্য নারীশ্রমিককে কাজে নেবেন যখন তিনি উন্নয়নশীল কোন দেশ থেকে সস্তা পুরুষশ্রমিককেই কাজে রাখতে পারেন? কেন তিনি অ-কাঠামোবদ্ধ (unstructured) নমনীয় খন্ডকালীন (Part-time) নারীশ্রমিককে কাজে নেবেন যখন তিনি সহজেই নমনীয় খন্ডকালীন পুরুষশ্রমিককেই কাজে নিতে পারেন? যখন বর্তমান পুঁজির বাজারে নমনীয় শ্রমের যোগানই বেশি প্রয়োজন, তখন নারী-পুরুষের বাছাই কীভাবে হবে? ক্রমবর্ধমান খন্ডকালীন কাজের জগতে নারীর অবস্থান কি সংকুচিত হতে চলেছে? পুরুষতান্ত্রিক এবং পুঁজিবাদী সম্পর্কের যে এক নতুন বোঝাপড়া চলছে সেখানে কি নারীরা এখনও দ্বিতীয় প্রধান হিসাবেই আবির্ভূত হবেন? ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের একটি বড় অংশ কি এখনও একটি চাকরীচুক্তি বের করতে চায় যেখানে পুরুষ শ্রমিকই প্রাধান্য পাবেন, না কি ট্রেডইউনিয়ন আন্দোলনে নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণের কারণে নারীর পক্ষে ভালো সিদ্ধান্ত আসবে? পুঁজিপতিরা এখনও যেহেতু মূলত পুরুষ তাদের সাড়া দেবার ধরণ কী হবে? এসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে নিহিত রয়েছে নারীদের ভবিষ্যত কাজের বাজার।
১৯৯৭ সালে রোমে অনুষ্ঠিত সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল উইমেন-এর “উইমেন অ্যান্ড গে­াবালাইজেশন অব দ্য ওয়র্ল্ড ইকোনোমি” শীর্ষক কনফারেন্সে এই উদ্বেগ দেখা গেছে। তাদের মতে, নয়া-উদারনীতির উদ্ভব এবং মুক্তবাজার দর্শন, যা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় সমাজকেই দেখে মূলত একটি বাজার হিসাবে এবং যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি একই সাথে উৎপাদক ও ভোক্তা, সমতা ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতি একটি সরাসরি হুমকি। এই নয়া-উদারনীতি নারীর কষ্টে অর্জিত বহু অধিকারের প্রতি হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠছে, বিশেষ করে শিক্ষার অধিকার, কষ্টার্জিত অর্থউপার্জনকারী কাজের অধিকার এবং স্বাস্থ্যসেবায় অধিকার। কেননা নয়া-উদারনীতিবাদ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সংকুচিত করে ফেলে, বিশেষ করে উত্তর উপনিবেশিক দেশগুলোতে, কেননা এসব রাষ্ট্রকে বিদেশি বিনিয়োগ আনার জন্য অনেক রাজনৈতিক ছাড় দিতে হয়।
আজকের দিনে মাত্র কয়েক শ’ বহুজাতিক কোম্পানি গে­াবালাইজেশনকে পরিচালিত করছে, যেসব কোম্পানীর অনেকগুলোরই আবার অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনেক দেশের সরকারের চেয়ে বেশি। ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকা এসব বহুজাতিক কর্পোরেশন মানবিক এবং শ্রমিক অধিকারকে উপেক্ষা করে, কেননা তাদের একমাত্র লক্ষ্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করা। এবং ক্রমশ এসব কোম্পানি ও কর্পোরেশনই বৈশ্বিক কাজের ধারা, অর্থায়ন, ভোগ, সংস্কৃতি- সবকিছুর অবয়ব নির্ধারণ করে দিচ্ছে। নারীরা কদাচিৎ এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে পারেন অথচ এসব সিদ্ধান্তের সবচেয়ে বেশি মাশুল নারীকেই গুনতে হয় কারণ ঐতিহাসিকভাবেই ব্যক্তি-মানব-পুঁজি (human capital) ও সামাজিক পুঁজির (social capital) দিক থেকে তারা অসুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। কয়েকটি উদাহরণ এ বিষয়টিকে খোলাসা করতে পারবে, ধারণা করি।
আফ্রিকায়, মোট খাদ্য উৎপাদনের প্রায় ৮০ ভাগ করেন নারী, অর্ধেকের বেশী ক্ষুদ্রচাষী নারী এবং খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রায় তিন/চতুর্থাংশ শ্রম-শক্তি হলেন নারী। অথচ জমিতে নারীর অধিকার নেই। জমিতে মালিকানা না থাকায়, এসব নারী না পান তাদের কাজের স্বীকৃতি, না পান উৎপাদনে সাহায্য, না পান শ্রমেঘামে ফলানো সম্পদে অধিকার।
আলজেরিয়া এবং অন্যান্য দেশে যেখানে যুদ্ধ, সন্ত্রাস এবং নানা ধরণের চরমপন্থী অবস্থা বিরাজ করছে সেসব দেশে দুর্দশার প্রথম শিকার নারী। ভারী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অগ্রহণযোগ্যমাত্রার দুর্দশা ও দারিদ্র বয়ে আনতে পারে। কিছু কিছু দেশে, যেমন আলজেরিয়াতে, আইএমএফ-এর চাপিয়ে দেয়া অবকাঠামোগত উপযোজন (structural adjustment) এক ধরণের সামাজিক বাজার অর্থনীতির জায়গায় দ্রুত অনিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতির বিস্তার নারীদের দুর্দশায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকায় নয়া-উদারনৈতিক নীতির আধিপত্যে এক ধরণের অনানুষ্ঠানিক নমনীয় শ্রম-ঘন্টার কাজের সেক্টর গজিয়ে উঠেছে, যেখানে কাজের বা স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কোন সুরক্ষা নেই। অনেক উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে অর্থকরী কাজের সুযোগ কম, মিলিয়ন সংখ্যক নারী মাইগ্রান্ট কাজকে বেছে নেয়, বিশেষত সেসব ক্ষেত্রে যেখানে তারা আবেগগত, মানসিক, শারীরীক এবং যৌন সন্ত্রাসের কাছে আরো বেশি অসহায়। এসব নারী যখন তাদের দেশের অর্থনীতিতে প্রকৃত অর্থেই অবদান রাখছেন, তখন একদিকে তারা শুধু মাইগ্রেশনের সামাজিক ক্ষয়ক্ষতির জন্যই যে শুধু অভিযুক্ত হচ্ছেন তাই নয়, বরং তারা থাকছেনও খুবই অরক্ষিত ।
নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং ব্যক্তিমালিকানাধীনকরণ হয়তো পণ্য ও সেবার উৎপাদনে দক্ষতা বাড়াতে পারে, কিন্তু একই সাথে দারিদ্র বৃদ্ধিরও কারণ হতে পারে। অনেক উন্নত দেশে, কাঠামোগত কর্মহীনতা নারীর জীবনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে কারণ তারাই বেশীরভাগ স্বল্প-বেতনের অস্থায়ী এবং খন্ডকালীন কাজগুলো করে থাকেন অথবা থাকেন দীর্ঘ-মেয়াদী বেকার (গায়েন ও অন্যান্য, ২০১০)। যেসব দেশে পরিকল্পিত অর্থনীতি ছিলো, সেসব দেশের নারীদের উপর এই বাজার অর্থনীতির খুবই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সামাজিক কল্যাণ ব্যবস্থার দেশগুলোতে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে সেগুলো এই নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে আক্রমণের মুখে পড়েছে এবং নতুন বাজার মতাদর্শ এসব প্রতিষ্ঠানকে হটিয়ে দিয়েছে বা দিচ্ছে। সরকারী সাবসিডি কেটে ফেলা এবং সামাজিক কল্যাণমূলক ব্যবস্থাগুলো তুলে দেয়ার বিষয়টি সবচেয়ে আঘাত হেনেছে নারীদের, দারিদ্র থেকে উত্তরণ তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
একদিকে যখন এই মুক্ত বাজার অর্থনীতি জাতীয় সরকারগুলোকে শিক্ষা, বাসস্থান, স্বাস্থ্য এবং শিশুকল্যাণ ক্ষেত্রে সাবসিডি কমিয়ে দেবার বা তুলে দেবার প্রস্তাব করছে যা নারীদের বোঝা অনেকটাই লাঘব করত, অন্যদিকে তারা তাদের নিয়োজিত পুঁজির সর্বোচ্চ মুনাফা করার জন্য নারীদের ব্যবহার করছে বিনোদন ও সৌন্দর্য ইন্ডাস্ট্রিতে।
নারীর দেহ সৌন্দর্যকে ঘিরে পৃথিবী জুড়ে বিশাল বাণিজ্য চলছে। বিলিয়ন ডলার ব্যবসা করছে ‘ওজন কমানো ইন্ডাস্ট্রি’ প্রতিবছর। এবং এই বাণিজ্য টিকেই আছে নারীর নিজের দেহের উপর ঘৃণা তৈরি করে। এসব সৌন্দর্য ইন্ডাস্ট্রি লাখো নারীকে বুঝ দিচ্ছে যে তাদের মুখের উপর কেমিক্যাল আবর্জনা, তোলা চিকণ ভ্রু যা কিনা আবার এঁকে ভরাট করতে হবে, এগুলোই হচ্ছে সৌন্দর্য। মডেলিং ইন্ডাস্ট্রি, যেমনটি বলেছেন স্পোর্টস সুইমসুট এডিশন, কসমো, কভার গার্ল-এর সাবেক কভার মডেল আন সিমনটন, আয়ত্তে আনা সম্ভব না এমন এক অলীক সৌন্দর্যের পক্ষে প্রচার চালায়। স্লীম হবার জন্য মেয়েরা না খেয়ে থাকে, বমি করে, স্টমাক স্টাপল করে রাখে, চোয়ালকে তার দিয়ে বেধে রাখে এবং মেদ বের করে ফেলে। নারীরা মোটা শুধু একথা বলেই ক্ষান্ত নয় সৌন্দর্য ইন্ডাস্ট্রি। নারীদের বলা হয় তাদের শরীরের সবকিছুরই উন্নয়ন দরকার। তাদের দাঁত যথেষ্ট সাদা নয়, সাদা নয় যথেষ্ট তাদের ত্বক, তাদের চোখ যথেষ্ট নীল নয়, চুল নয় যথেষ্ট উজ্জ্বল- তাদের শরীরের কিছুই ঠিক নয়। আমাদের সব দেশে ত্বক ফর্সাকারী উপাদানের প্রচার যখন তুঙ্গে, তখন পাশ্চাত্যে ত্বক তামাটে করার বাণিজ্য রমরমা। এবং এই তালিকা বেড়েই চলেছে। আমেরিকান সোসাইটি ফর এসথেটিক প­াস্টিক সার্জন-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০০১ সালে ৮.৫ মিলিয়ন কসমেটিক সার্জারী সম্পন্ন হয়েছে, ২০০০ সালের তুলনায়, মাত্র এক বছরে এর বৃদ্ধি ঘটেছে ৪৮% । তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সাল নাগাদ এই কসমেটিক সার্জারির সংখ্যা ৫৫ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। এবং এই বৃদ্ধি যে শুধু আমেরিকায় হচ্ছে তা-ই নয়, এশিয়াতে এই বৃদ্ধি ঘটছে বছরে ২০%। ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব ­প্লাস্টিক সার্জনস-এর হিসাব (২০০০) অনুযায়ী, জার্মানীতে এই বৃদ্ধি বছরে ১৫% এবং বৃটেনে ৩০%।
এই ধারাকে বজায় রাখা এবং বাড়ানোর জন্য নারীর বিরুদ্ধে এক ধরণের মতাদর্শিক লড়াই সব সময়েই জারী রাখা হয় গণমাধ্যমের সাহায্যে। শুধু বিজ্ঞাপনেই নয়, নাটক, সোপ অপেরা, চলচ্চিত্র, ম্যাগাজিন বা টেলিভিশনের বাণিজ্যিক শোগুলোতে নারীর শরীরকে শুধু যে প্রসাধনী বা পোষাকের বিপনণে ব্যবহার করা হয় এমন নয় বরং সেইসব পণ্যেও হামেশাই ব্যবহার করা হয় যার সাথে নারী শরীরের কোন যোগ নেই। তবে এক্ষেত্রে যোগ না থাকলেও নারীকে একটি নির্দিষ্ট উপায়ে দেখানোর চাপ এবং নারীকে একটি নির্দিষ্ট ধারায় কাজ করতে বলার মধ্যে পরিস্কার যোগসূত্র রয়েছে। নারীর যেসব গুণাবলীকে সুন্দর, নমনীয় বিবেচনা করা হয়, সেগুলোকেই নারীর কাংখিত ব্যবহার হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। গণমাধ্যমে উপস্থাপিত নারীর ইমেজ নারীর চিরায়ত লিঙ্গ ভূমিকাকেই পাকাপোক্ত করে। এখানে এসে পুঁজিবাদ, নারী প্রসঙ্গে, আরেকবার পুরুষতন্ত্রের সাথে সন্ধি করে।
এমনকি যেসব নারী এমন কাজে রয়েছেন যেখানে শারীরীক শক্তি ও ক্ষমতার প্রদর্শন অনিবার্য, সেই শক্তিকে এড়িয়ে যৌনতা ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উপরই জোরারোপ করা হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, দ্বিতীয়বার ইরাক যুদ্ধ শুরু হবার পরে, যুক্তরাজ্য ও কানাডার এক নম্বর সৌন্দর্য ম্যাগাজিন গ­্যামার একটি প্রবন্ধ ছাপায় যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নারী সৈনিকদের মেকওভার সম্পর্কে। বলা হয়, নারী সৈনিকেরা যখন যুদ্ধে যান তখন কীভাবে মরুঝড়ের মধ্যেও তাদের লিপস্টিক ঠিক রাখতে পারবেন, কিংবা কীভাবে ঘাম ধরে রাখা যাবে যাতে ঘাম তাদের মেকআপ নষ্ট করতে না পারে। অনেকে মনে করেন যে, অ-প্রাপনীয় সৌন্দর্যের দিকে নারীদের ব্যাপৃত রাখা হয় অর্থনীতি বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রাখবার জন্য, যেমনটা করে থাকে অন্যান্য যুদ্ধ। এভাবেই তথাকথিত সৌন্দর্য-ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে পুঁজিবাদ নারীর বিরুদ্ধে জারী রেখেছে এক ভিন্ন ধরণের প্রলোভনযুদ্ধ।
বাজার মৌলবাদ মোকাবেলায় নারী
যদিও নারীমুক্তি আন্দোলন ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সোচ্চার, তথাকথিত বিশ্বায়ন এবং নয়া-উদারনৈতিক অর্থব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান এখনো পর্যন্ত খুব জোরালো নয়। তবে কোথাও যদি তেমন কোন আন্দোলন হয়েও থাকে, সেই আওয়াজ বেশি দূর ছড়াতে পারে না, মূলধারার গণমাধ্যমে স্থান পায় না বলেই হয়তো। মূলধারার গণমাধ্যমে স্থান না পাবার কারণ গণমাধ্যম ও নতুন ধারার প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো খুবই কম। জেনকিনস (২০০৮)-এর তথ্য অনুযায়ী, যে নারী বিশ্ব জনসংখ্যার ৫২%-এর প্রতিনিধিত্ব করেন, ৩%-এরও কম রেডিও ও টেলিভিশন সেন্টারের মালিক তারা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবস্থানে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই, নারীর অনুপাত মাত্র ৩%।

তবে একমাত্র যে আওয়াজটি এখনো পর্যন্ত এই নয়া-উদারনৈতিক ব্যবস্থায় নারীর অর্থনৈতিক অধঃস্থনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার দেখা যায়, সেই আওয়াজটি Socialist International Women (SIW)- এর। ১৯৯৭ সালে Women and the Globalisation of the World Economy শীর্ষক প্রস্তাব থেকে তারা এই প্রচারটি চালিয়ে আসছেন। SIW অবিলম্বে পৃথিবীজোড়া সকল ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে একত্রিত হয়ে মাইগ্রেশন, অ-প্রাতিষ্ঠানিক, এবং নমনীয় শ্রমঘন্টার কর্মকাঠামোতে ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্বের সকল শ্রমিকের পক্ষে দাঁড়ানোর উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন। SIW জাতিসংঘের কাছে দাবী জানিয়েছে মাইগ্রান্ট নারী শ্রমিক এবং তাদের পরিবারে অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের কনভেনশনকে সংশোধন করার। সেই সংশোধনী জাতিসংঘের সকল আন্তর্জাতিক দলিলে, যেমন, চতুর্থ নারী সম্মেলনের দলিল, সামাজিক উন্নয়নের বিশ্ব সম্মেলন দলিল, জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের দলিল, এবং মানবিক অধিকার বিষয়ক কনফারেন্সের দলিলে অন্তর্ভূক্ত করার দাবী জানিয়েছে। SIW আন্তর্জাতিক, জাতীয় এবং আঞ্চলিক সকল পর্যায়ে কাজের জগতে জেন্ডার সংবেদী নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণের ব্যাপারে চাপ তৈরিতে সমন্বিত রাজনৈতিক সক্রিয়তায় যাবার জন্য ডাক দিয়েছে। কিন্তু এই ডাকে যে খুব বেশি সাড়া পড়েছে এমন দাবি করা যাচ্ছে না, সারা পৃথিবীতেই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের তো বটেই, শ্রমিক আন্দোলনেরই বড় দুর্দিন।
বিপরীত অথচ সমান্তরাল অন্য একটি ধারাও ক্ষীণভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। আফরেই (১৯৯৯) জানাচ্ছেন, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ইসলামিক অর্থায়ন, যা মূলত মধ্যপ্রাচ্যের ও সৌদি আরবের ধনী ব্যক্তিদের অনুদান এবং আন্তর্জাতিক ইসলামি এনজিও-র মাধ্যমে বিলি করা হচ্ছে, স্বল্প আয়ের নারীদের আকৃষ্ট করছে। বেশ কিছু তরুণও এই অর্থায়নের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন এক অলীক আশা থেকে যে এই অর্থনীতি হয়তো আইএমএফ বা অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্ষমতাকাঠামো থেকে তাদের মুক্ত করবে এবং ব্যাপক হারে বেকারত্ব, ছদ্ম-বেকারত্ব থেকে তাদের মুক্তি দেবে। নারীবাদের নয়া পুরুষতান্ত্রিক মডেলের অন্তর্গত নারীরা ভাবছেন পরিবারের পুরুষ সদস্যদের অপেক্ষাকৃত ভালো শিক্ষার ব্যবস্থা করবে এই অর্থ যা ভালো চাকরির নিশ্চয়তা দেবে এবং এভাবেই পারিবারিক জীবনে এক ধরণের নিশ্চয়তা ফিরে আসবে, যার চুঁইয়ে পড়া প্রভাব তার জীবনেও আসবে।
পাশ্চাত্যের নারীবাদীরা গণমাধ্যমে নারীর অপ-রূপায়ন প্রসঙ্গে প্রচুর লিখেছেন। এসব লেখালেখির মাধ্যমে একধরণের সচেতনতা অবশ্যই তৈরি হচ্ছে, বিশেষ করে একাডেমিক এবং অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে। এমনকি এসব লেখালেখির মাধ্যমে নানা ধরণের কোর্স চালু হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু এসব লেখালেখি বাস্তব অবস্থার খুব পরিবর্তন আনতে পেরেছে সমাজে, নিদেনপক্ষে গণমাধ্যমগুলোতেও, এমনটা বলা মুশকিল। গণমাধ্যমে এবং সমাজে এই পরিবর্তনহীনতার কারণ বোঝা যায়। সম্পদ এবং গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ এখনো খুবই সীমিত। গণমাধ্যমে নারীর বাণিজ্যিক অপরূপায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ খুবই ইস্যু-ভিত্তিক, মোটেই কোন পূর্বাপর সমন্বিত পরিকল্পিত কোন কাঠামো নেই এসব প্রতিবাদের। এসব প্রতিবাদও আবার মূলধারার গণমাধ্যমে বা জনপরিসরে জায়গা পায় না। এসব অপরিকল্পিত, বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদকে সামান্যই আমলে নেয় তাই কর্পোরেট পুঁজি। কাজেই সৌন্দর্য ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসা বেড়েই চলেছে। তবু কিছু কিছু প্রতিবাদ আন্দোলনের রুপ নিচ্ছে। যেমন, ফেমিনিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব আইসল্যান্ড দীর্ঘদিন যাবত গণমাধ্যমে নারীর নেতিবাচক ইমেজ উপস্থাপনের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে, রাজনীতিবিদদের সাথে আলাপে বসছে নির্বাচনের আগে, এবং অলটারনেটিভস অব বিউটি ধরণের প্রদর্শনীর আয়োজন করছে যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্বসেরা নারীদের কাজকে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এ’জাতীয় অসংখ্য ছোট ছোট গ্রুপ ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবীতে, মুশকিল হলো তাদের মধ্যে কোন নেটওয়ার্ক নেই।
অনেক তাত্তিক মনে করছেন, নারীদেহের অত্যধিক ব্যবহার ও প্রদর্শনীর প্রতি বিরাগ থেকেও পর্দা, হিজাব জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তরুণ, শিক্ষিত, অবিবাহিত মুসলিম নারীদের মধ্যে। নারী শরীরের পণ্যায়ন, জনপ্রিয় নান্দনিকতার অবয়বে কিংবা স্থুলতার নির্লজ্জ প্রকাশে, যেভাবেই হোক না কেন, সেক্যুলার কিংবা ইসলামিক নারী- উভয়েই অপছন্দ করছেন। আর এই অবসরে ধর্মীয় মৌলবাদী তাত্তিকরা তাদের এজেন্ডা নিয়ে এগিয়ে আসছেন, ‘ধর্মীয় ড্রেসকোড’-ই, কেউবা আরো একটু এগিয়ে ‘ধর্মীয় জীবনব্যবস্থাই’ জনপরিসরে নারীর সামাজিক মর্যাদাকে নিশ্চিত করতে পারে– এমন দাবী নিয়ে আসছেন। কিন্তু সেখানেও থেমে নেই বাজার। মৌলবাদের সাথে বাজার কীভাবে গাঁটছড়া বাধে তার এক অসাধারণ উদাহরণ দাখিল করেছেন মালয়েশীয় নারীবাদী তাত্ত্বিক ওথমান (২০০৬)। একটি বিজ্ঞাপনকে উলে­খ করেছেন যা মালয় আঞ্চলিক টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে ২০০৩ সালে। এটি একটি শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটিতে একজন সুন্দর মুসলিম মালয় নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে যে তার স্বামীকে খুশী করার জন্য’ তার চুলের যত্নে বিজ্ঞাপনের শ্যাম্পুটি ব্যবহার করেন। বিজ্ঞাপনটি ওই নারীর হিজাববিহীন মাথাটিকে কখনোই দেখায় না, কিন্তু দেখায় তার স্বামীর তৃপ্ত হাসিমুখ যে তার স্ত্রীর সদ্য শ্যাম্পু করা চুল দেখে মুগ্ধ। একই নারী শরীরে ধর্মীয় মৌলবাদ ও বাজারের যৌথ আক্রমণকে বোঝাতে এর চেয়ে আর ভাল উদাহরণ কী হতে পারে!
মুশকিল হলো, নারীমুক্তি আন্দোলনের ক্রমশ পৃথক হয়ে ওঠা দুই ধারাই, আফরেই (১৯৯৯) উত্থাপিত ‘দ্বি-নারীবাদের’ নারীবাদী ধারা এবং পুরুষতান্ত্রিক ধারা, বর্তমান বিশ্বে নারীর প্রতি সহিংসতার অর্থনৈতিক এবং বহুধর্মীয় মৌলবাদের জটিল পরিস্থিতিকে আমলে আনতে এবং মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থানকে অনেকেই পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক মডেলের ব্যর্থতা হিসাবে দেখছেন। মারনিসি (১৯৮৯)-র মতে, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে সেক্যুলার, উত্তর-উপনিবেশিক কর্তৃত্বপরায়ণ দেশগুলোয়, যারা আইএমএফ বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির রীতি অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করে, তাদের ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া হিসাবে। নারীবাদ, নারীমুক্তি আন্দোলন আবার মৌলবাদকে প্রত্যাখ্যান করে, বাজারকে সেভাবে নয়। আবার মৌলবাদের কারণে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার নামে যে সেক্যুলার রাজনীতির বিরোধী একটি ধারা গড়ে উঠছে সারা পৃথিবীতে, সেটিও নারীর মুক্তির পথ তো নয়-ই বরং এযাবতকালে নারীমুক্তি আন্দোলনের যা কিছু অর্জন তার পায়ে কুড়াল চালানো। যে কোন একপক্ষ নেয়া তাই খুব বিপজ্জনক। মানুষের মুক্তির যে রাজনীতি এই জটিল পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে পারতো, সেই রাজনীতি যেমন অনুপস্থিত বিশ্ব-প্রেক্ষাপটে, তেমনি নারীবাদী আন্দোলন আজ ইস্যু-ভিত্তিক অ্যাক্টিভিজমের ঘেরাটোপে বন্দী। নারীমুক্তি আন্দোলন জাতীয় গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের সাথে যেমন বিযুক্ত হয়ে পড়েছে তেমনি হারিয়েছে এই লড়াইয়ের আন্তর্জাতিক চরিত্র। নারীমুক্তি আন্দোলন যে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক আন্দোলন, যেমনটা বলেছিলেন রোজা লাক্সামবুর্গ, বোঝাপড়ার এই অবস্থানটি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। আজকের নারীমুক্তি আন্দোলনের রাজনীতিটি জারি থাকা দরকার তিন-মাত্রিক স্তরে: বাজার মৌলবাদের বিপক্ষে, ধর্মীয় মৌলবাদের বিপক্ষে, এবং গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের পক্ষে। সে লড়াইটি কেবল নারীর একার নয়, গণতান্ত্রিক শিবিরের সকল নারী-পুরুষের, এবং এই সত্য যত দ্রুত বোঝা যাবে ততই মঙ্গল। শুধু একটু পা চালিয়ে।

তথ্যসূত্র:
Afray, Janet. (1999), “Dossier 21: The War Against Feminism in the Name of the Almighty: Making Senses of Gender and Muslim Fundamentalism”, Women Living Under Muslim Law.
Folbre, Nancy and Hartmann, Heidi. (1989), “The persistence of patriarchal capitalism”, Rethinking Marxism, 2(4): 90-96.
Gayen, Kaberi, McQuaid, Ronald and Raeside, Robert. (2010). “Social Networks, Age Cohorts and Employment”, International Journal of Sociology and Social Policy30(5/6): 219-238.
Hartmann, Heidi. (1981), “The unhappy marriage of Marxism and Feminism: Towards a more progressive union”, in Lydia Sargent (Ed.), Women and revolution: A discussion of the unhappy marriage of Marxism and feminism. Boston: South End Press.
Jackson, Stevi (1992). “Towards a historical sociology of housework: A materialist feminist analysis”, Women’s Studies International Forum, 15: 153-172.
Jensen, Robert. (2006), “The Threats to Suatainabl Democracy: The Four Fundamentalisms”. Counterpunch, May 30.
Mernissi, Fatima. (1989). Doing Daily Battle: Interview with Moroccan Women, New Jersey
Othman, Norami. (2006), “Muslim women and the challenge of Islamic fundamentalism/extremism: An overview of Southeast Asian Muslim women’s
struggle for human rights and gender equality”, Women’s Studies International Forum 29: 339–353.
Pateman, Carole. (1988). The Sexual Contract. Oxford: Basil Blackwell.
Probert, Belinda. (1989). Working life. Melbourne: McPhee Gribble.
Reed, Betsy (ed.) (2002), Nothing Sacred: Women Respond to Rligious Fundamntalism and Trror, Nation Books.
Walby, Sylvia. (1990). Theorizing Patriarchy. Oxford: Basil Blackwell.

কাবেরী গায়েন: গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং গবেষক।
মার্চ ২৮, ২০১১

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

কিছু কালোসিধে কথা বলতে চাই



Kaberi-Gaen-111ভেবেছিলাম লিখবো না, কারণ লিখে খুব কিছু হয় যে সবসময় এমন দাবি করা যাচ্ছে না, এবং শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ফাহমিদা বা গণযোগাযোগ বিভাগের মেধাবী ছাত্রী সুতপা’র মৃত্যুকে কেন্দ্র করে লেখালেখি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে এ’সব লেখালেখি করে নিজে খানিকটা সান্ত্বনা পাওয়া যায় যে ছিলাম আমিও প্রতিবাদে, এর বাইরে খুব যে কাজ হয় তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবুও আজ লিখছি বা বলা ভালো যে না লিখে পারছি না এই অন্তর্গত তাড়না থেকে যে সত্যিই যখন আজ রুমানা দেশে ফিরেছেন তার ডান চোখের আলো ফিরে পাবার শেষ আশ্বাসটুকু ছাড়াই তখন ওই যে আমিও ছিলাম প্রতিবাদে কেবল সেই গোঁয়ার সান্ত্বনাটুকুর জন্যই হয়তো এই লেখা। ভেতরে কোথায় যেন একটা শুভবোধ কাজ করছিলো যে অন্তত এক চোখের আলো তার ফিরে আসবে। সেই শুভবোধের, আশার ক্ষীণ আলোটিও যখন শেষ হয়ে গেলো, তখন আমি সত্যিই কিছু কালোসিধে কথা বলতে চাই।
যে অন্ধত্ব এবং আপোষ কেড়ে নিয়েছে চোখের আলো
কথা খুব সহজ। রুমানা মঞ্জুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। কানাডার বৃটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি গবেষণারত। তার শিক্ষার্থীদের বয়ানে জানা যায় (বিভিন্ন ব্লগে, ফেসবুকে মন্তব্য থেকে) তিনি একজন জোরালো শিক্ষক। তার পারিবারিক অবস্থানও অত্যন্ত জোরালো, বাবা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা। স্বামী সুদর্শন এবং বুয়েট থেকে পড়াশুনা করা। সহকর্মীরা দাবি করেছেন তার অমায়িক আচরণের কথা। কানাডা থেকে তার প্রতিবেশীরা একত্রিত হয়ে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেছেন তার স্বামী’র শাস্তি দাবি করে এবং সেখানে তারা উল্লেখ করেছেন রুমানাকে তাদের আড্ডায়-আসরে খুব বেশি পাওয়া যেত না কারণ তিনি ক্যাম্পাস থেকে ফিরে প্রতিদিন ফোন করতেন তার মেয়ে এবং স্বামীর সাথে কথা বলার জন্য। এভাবে শিক্ষিত স্বাবলম্বী শক্তিশালী অবস্থানের সংসারমুখী রুমানা মঞ্জুর সমাজের প্রতিষ্ঠিত ভালো মেয়ের এবং আদর্শ স্ত্রী’র সব তরিকা পূরণ করেছেন। কিন্তু তবুও তাকে স্বামীর হাতে নির্যাতিত বলে নির্যাতিত, একেবারে দু’টো চোখই খুইয়ে বসতে হয়েছে। তার নাক কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছে সেই স্বামী, যাকে তিনি একদিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। প্রায় সব পত্রিকায় আরো যে খবরটি এসেছে তা হলো তিনি গত দশ বছর ধরেই কম-বেশি নির্যাতন সহ্য করে এসেছেন। এমনকি এবার আসার পরও না কি তার বেকার স্বামী, যিনি তার বাবার বাড়িতেই থাকেন, তাকে তিন দিন একটি ঘরে আটকে রেখেছেন। সবশেষে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারে (২০ জুন, ২০১১) রুমানা মঞ্জুরের বাবা বলেছেন মেয়ের জীবন এবং তার পরিবারের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে তারা শংকিত।


সংবাদ সম্মেলনে রুমানা। ছবি. মুস্তাফিজ মামুন।
সংবাদ সম্মেলনে রুমানা। ছবি. মুস্তাফিজ মামুন।

স্বাভাবিকভাবেই দেশবাসীর সহানুভূতি রুমানার সাথে। আমি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকর্মী হিসাবে ঘটনার শুরু থেকেই বেদনা এবং ক্ষুব্ধতার কোন তল পাচ্ছি না। একই অবস্থা প্রায় সবার। সবাই এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাইছেন। আমিও চাই, এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তাকে দেয়া হোক যেনো ভবিষ্যতে কেউ এমন করার আগে সম্ভাব্য শাস্তির ভয়াবহতা মনে করে হলেও উদ্যত হাত নামিয়ে ফেলে। এ’কথা সত্য এ’জাতীয় ঘটনা বাংলাদেশের অনেক ঘরেই ঘটে কিন্তু এই ঘটনাটি এতো আলোড়ন তুলেছে এ’কারণেই যে প্রায় অবিশ্বাস্য রকমের নিখুঁত অবস্থানের একজন নারীও কতখানি অসহায় হয়ে উঠতে পারেন মুহূর্তে এবং তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এমন একজন নারী কীভাবে দশবছর ধরে এই নির্যাতনকারীর সাথে ঘর করেছেন প্রশ্ন উঠছে সে বিষয়েও। এই ‘কীভাবে’র উত্তরটি খুঁজতে যাবার আগে আরো একটি প্রয়োজনীয় তথ্য উল্লেখ করে রাখতে চাই। রুমানা নির্যাতিত হবার সাতদিন পরে ঘটনাটি গণমাধ্যমে আসতে পেরেছে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অফিসিয়ালি অবগত হয়েছে। জানা যায়, পরিবার থেকেই বিষয়টি চেপে রাখার একটি ব্যাপার ছিলো। ঘটনার অন্যদিকে, খবরটি গণমাধ্যমে আসার অনেক পরে আসামী গ্রেফতার হয়েছেন, সব মিলিয়ে তিনি প্রায় দশদিনের মত সময় পেয়েছেন নিজেকে গুছিয়ে নেবার। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেবার আগ পর্যন্ত পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি অথচ প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ গ্রেফতার করতে পেরেছে। কারণ সম্ভবত নির্যাতক হাসান সাইদ জনৈক মন্ত্রীর ভাই। তার এই সামাজিক পরিচিতিটি গুরুত্ত্বপূর্ণ এ’কারণে যে এই অবস্থানের কারণে তিনি পালিয়ে থাকতে পেরেছেন অথচ গণমাধ্যমে তার বেকারত্ব থেকে শুরু করে নানা ধরনের অসহায় অবস্থানের বিষয়টি তুলে ধরে তার আচরণের প্রতি একধরনের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টাও করেছেন। দ্বিতীয়ত, গ্রেফতার হবার পর সাইদ হাসান প্রথমেই চেষ্টা করেছেন নিকৃষ্টতম পদ্ধতি দিয়ে শুরু করতে আর তা হলো রুমানার সাথে এক ইরানী তরুণের ‘অবৈধ’ প্রেমের গল্প ফাঁদা, যা আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় প্রায় অব্যর্থ মহৌষধের কাজ করে। ফলে রাতারাতি আরেকটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেলো যারা সাইদের অসহায় দৃষ্টিশক্তিহীন কর্মক্ষেত্রে অসফল এবং প্রতারিত স্বামীর ইমেজের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলেন। যদিও পরে তিনি স্বীকার করেছেন এটি বানানো, তার স্ত্রীর এমন কোন সম্পর্ক নেই। মোটামুটি এই কাঠামোর ভেতর থেকে, পারিবারিক সহিংসতার এই ঘটনা থেকে কয়েকটি প্রবণতা বের করে আনতে চাই। এই প্রবণতাগুলো বের করে আনতে যে চলকগুলো ব্যবহার করা হবে তা হলো, নির্যাতক, নির্যাতিত, সমাজ এবং রাজনীতি।
নির্যাতক সাইদ এবং পুরুষতন্ত্র
শুরু করছি সাইদের ঘটনা থেকে। প্রথমত, সাইদ বুয়েটের পড়ালেখা শেষ না করা, বার বার ব্যবসায় ব্যর্থ, প্রায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, অসফল এবং হতাশ এক পুরুষ, যে নিজের অক্ষমতার জ্বালা মেটাতে চেয়েছে, তার বক্তব্য অনুযায়ী, রুমানাকে খুন করে। এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে সে সাফল্যের পরিচয় দিতে পেরেছে। প্রাণে মেরে ফেলতে না পারলেও কামড়ে রুমানার নাক তুলে নিয়ে এবং চোখ উপড়ে ফেলে সে একবার তার ‘পুরুষত্বের’ জানান দিতে পেরেছে। অর্থাৎ একজন সব অর্থে অসফল পুরুষ, সব অর্থে একজন সফল নারীকে (সাইদকে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের মত অসফল কাজটি করা ছাড়া) নিজের কব্জায় রাখার জন্য মেরে ফেলতে চেয়েছে। এই চাওয়ার বৈধতা হলো তার স্বামীত্ব। স্বামীত্ব হলো সেই প্রভুত্ব যা দিয়ে স্ত্রীকে মেরে ফেলার চিন্তা পর্যন্ত করা চলে এবং সেই চিন্তা ও কাজের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করা সম্ভব।
এই ভয়াবহ অপরাধটি সংঘটিত করে সাইদ কিন্তু অনুতপ্ত হননি বরং দ্বিতীয় অপরাধটি করার প্রস্তুতি নিয়েছেন। তার স্ত্রী’র চরিত্রে কালি দিতে চেয়েছেন কল্পিত প্রেমিকের গল্প ফেঁদে। অর্থাৎ শারীরীকভাবে প্রায় খুন হয়ে যাওয়া মেয়েটিকে তিনি তখন সামাজিকভাবে খুন করতে চেয়েছেন। নিজের অপরাধকে লঘু করার জন্য স্ত্রীকে খুন করতে এবং তার চরিত্র কলঙ্কিত করতে তিনি এতটুকু বিচলিতবোধ করেননি। এখানেও তার স্বামীত্ব তার অহম-কে তৃপ্ত করতে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কাজটি তিনি করতে পেরেছেন কারণ প্রতারিত স্বামীত্বের ইমেজ তৈরি করতে পারলে স্ত্রী’র বিরুদ্ধে যে-কোন অন্যায়কে আমাদের সমাজ এখনো বৈধতা দেয়, আইন না দিলেও। যেমন ’পতিতা’ প্রমাণ করতে পারলে যে কোন ধর্ষণ বা খুনের মামলা থেকে সামাজিকভাবে মুক্তি পাওয়া যায় । ইয়াসমীন হত্যা বা জেলের কাস্টডিতে থাকার সময় পুলিশের দ্বারা প্রথমে ধর্ষিত ও পরে খুন হয়ে যাওয়া সীমার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি কীভাবে তাদের পতিতা বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো। যেনো একজন পতিতাকে খুন করা জায়েজ। সাইদ সেই চেষ্টা এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। (মানবজমিন, ২১ জুন ২০১১)।
নির্যাতিত রুমানা এবং তার পরিবার
রুমানার দুই চোখের আলো নিভে গেছে। ক্ষতবিক্ষত নাক এবং মুখমন্ডল নিয়ে তিনি ধুকছেন হাসপাতালে। রুমানার প্রতি সহানুভূতি ও শুভকামনার সাথে সাথে একটি প্রশ্ন জোরালো হয়ে উঠছে, কেনো তিনি এতো দিন ধরে এই নির্যাতন সহ্য করেছেন? তার পর্যায়ের এক নারীর তো এমন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কথা না। ধর্ম এবং আইন-দুই-ই বৈধতা দিয়েছে অসহনীয় বিবাহিত সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলার। যেহেতু এই প্রশ্ন করার অবস্থায় রুমানা নেই তাই ধারণা করে নিতে হচ্ছে, হয়তো সম্পর্কটি টিকিয়ে রাখার ভালোমানুষী চেষ্টা যা ভালাবাসা থেকেই উৎসারিত বা সন্তানের মুখ চেয়ে থেকে যাওয়া বা সামাজিক দৃশ্য-অদৃশ্য চাপের কাছে নতি-স্বীকার। হয়তো সবগুলোই সত্য। শেষ অনুমিতিটিই প্রবল হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় নির্যাতনের সাতদিন পর্যস্ত এই ঘটনাটি অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স লাউঞ্জের মূখ্য আলোচনার বিষয় হলেও অফিসিয়ালি সেটা পরিবার থেকে জানানো হয়নি। না বিশ্ববিদ্যালয়কে, না গণমাধ্যমকে। আমরা এখনো জানিনা, সাইদের পক্ষ থেকে কী ধরণের চাপ ছিলো কিন্তু যদি ধরেও নেই সাইদের পক্ষ থেকে প্রবল কোন চাপ ছিলো কিন্তু তাই বলে হত্যাচেষ্টার পুলিশকেস করা হবে না সাতদিন পর্যন্ত, এ কেমন কথা? তা’হলে কি পরিবার তখন পর্যন্ত ঘটনাটি চেপেই রাখতে চাইছিলো? নির্যাতিত রুমানা এবং তার পরিবারও পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন-কাঠামোকে টিকিয়ে রাখছেন।
সামাজিক অনুভব কাঠামো
আপাতঃদৃষ্টিতে রুমানাকে এইমতো সম্পর্কের রেশ এতো দীর্ঘদিন বয়ে নেবার জন্য দায়ী করাই যায় কিন্তু একটু খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে তার সন্তানের নিরাপত্তা এবং পিতৃপরিবারের সম্মানের কথা ভেবে তিনি সরে যেতে পারেন নি। পরিবারও তাকে উৎসাহিত করতে পারেনি সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে। সুতপার ক্ষেত্রেও দেখেছিলাম তার মৃত্যুর পর তার ভাইবোনেরা বলেছেন সুতপাকে তার স্বামী প্রায়্ই মারধোর করত। তখনও আমার প্রশ্ন ছিলো যে আদরের বোনকে হারিয়ে তারা পাগল-প্রায়, সেই বোনের দিনের পর দিন নির্যাতনের কাহিনী শুনেও তারা কেন বোনকে ওই বিয়ে থেকে সরিয়ে আনেন নি। সুতপার ক্ষেত্রে পরিবারকেই দায়ী করতে হয় কারণ সুতপা তখনও ছাত্রী, অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করেন নি। রুমানার ক্ষেত্রে তো তা নয়, কিস্তু সত্য হলো রুমানা সরে আসতে পারেন নি। আমরা যে সামাজিক অনুভব কাঠামোর মধ্যে বসবাস করি সেখানে দৃশ্য-অদৃশ্য এতো চাপ থাকে যা অতিক্রম করার জন্য তথাকথিত ‘ভালো মেয়ে’ বা ‘ভালো স্ত্রী’র ইমেজটিকে পরিত্যাগ করার মত মানসিক দৃঢ়তা না থাকলে এই নিপীড়নের সাথেই বসবাস করতে হয়। আমাদের রুপকথা থেকে শুরু করে কাব্যে, সাহিত্যে, পুঁথি-পাঁচালিতে, প্রবাদে, পুরাণে, ধর্মে, ইতিহাসে, উপন্যাসে, গানে, নাটকে, চলচ্চিত্রে ভালো নারীত্বের যে ‘গুণী অথচ দুর্বল’ এবং পুরুষের প্রতি নির্ভরশীল, যা পিতা পুরুষ থেকে স্বামী পুরুষে হস্তান্তরের প্রক্রিয়ামাত্র, তকমাটা এঁটে দেয়া হয়েছে রুমানারা হয়ে উঠেছেন সেই ভালো নারীত্বের প্রতিনিধিত্বকারী অসহায় শিকার। আর তাই তিনি যখন আক্রান্ত তখনও দেখি একদল পত্রিকা চায় তাকে পৃথিবীতে অসম্ভবপ্রায় নিষ্কলুষ চরিত্রের (যেমন তিনি মৃদুভাষী, পাঁচবেলা নামাজ পড়েন, মাথায় কাপড় দিয়ে কানাডার প্রতিবেশীদের সাথে দেখা করেন, কানাডার প্রতিবেশীরা তাকে চেনেন তার মিষ্টি ব্যবহার এবং ভালো রান্নার জন্য ইত্যাদি) করে উপস্থাপন করতে, আরেকদল পত্রিকা চায় তার কথিত প্রেমের কাহিনী চাউর করে সাইদের অপরাধের ভার লাঘব করতে। দুই ক্ষেত্রেই রুমানার প্রতি কতটা সহানুভূতি থাকবে তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হয় তথাকথিত ভালোমেয়ের সার্টিফিকেট সাপেক্ষে। এবং সাইদ নাক থেতলে, চোখ তুলে না নেয়া পর্যন্ত রুমানার এই বিয়ে-সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার বৈধতা তৈরি হয় না।
তা’হলে প্রশ্নটা হলো, যদি রুমানার সত্যিই অন্য কোন পুরুষের সাথে নতুন করে সম্পর্ক গড়ে উঠতো, তা’হলেও সাইদ এই অত্যাচারের অধিকারী কি না বা রুমানার উপর চালানো এই ভয়াবহ অত্যাচারের প্রতিবাদে আমরা দাঁড়াবো কি না। প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলো, না। সাইদ বড়জোর বিয়ে-বিচ্ছেদের নোটিশ দেবার অধিকারী। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হলো, অবশ্যই। একজন নির্যতিত মানুষের পাশে সমর্থন নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য তার চারিত্রিক সনদ হাতে রাখার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সামাজিক অনুভব কাঠামোতে এই সত্যটিকে নিয়ে আসার জন্য সচেতন মেয়েদের যেমন এগিয়ে আসতে হবে তেমনি সচেতন রাজনৈতিক প্রতিরোধের প্রয়োজন রয়েছে।
কেন এটিও রাজনৈতিক লড়াই
কেন কোন মেয়ে নির্যাতিত হয়েও বিবাহিত সম্পর্কে টিকে থাকতে চায় বা মেয়েকে নির্যাতিত জেনেও তার পরিবার সেই সংসারটি টিকিয়ে রাখতেই মদদ দেয়? এই লৈঙ্গিক সংস্কৃতিটি বুঝতে হবে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রীয় সম্পর্কের সাপেক্ষে। স্বামীর বাড়ি থেকে বের হয়ে আসা মানে তার আর নিজের কোন জায়গা না থাকা। নারী বঞ্চিত তার উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে। মেয়েটির পরিবারে ফিরে আসা মানে ভাইয়ের সম্পত্তিতে অংশভাগ নেয়া। বাবার বা ভাইয়ের পরিবার মেয়ে-জামাই-নাতি এলে তাকে মুরগী জবাই করে খাওয়াতে আগ্রহী কিন্তু মেয়েকে সেই সম্পত্তির অংশভাগ দিতে আগ্রহী নয় পিতা বা ভাই নামের পুরুষতন্ত্র। আগ্রহী নয় তার এবং তার সন্তানের দেখভাল করার দায়িত্ব নিতে। অথচ মেয়েকে গুনী হিসাবে তৈরি করলেও তাকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলেনি পরিবার এবং সমাজ। বিয়ের সময় খুব বড় শিক্ষিত পরিবারেও বলতে শুনেছি, ‘আমার মেয়ে শুধু কলেজে যায় আর বাসায় আসে। আমরাই সাথে করে নিয়ে যাই আবার নিয়ে আসি। ও পথ-ঘাটও চেনে না।’ কাজেই স্বামীর সংসার থেকে ফিরে আসা মানে স্নেহময় পিতা কিংবা ভাইয়ের উপর নির্ভরশীলতা। বিয়ে দেবার মধ্য দিয়ে পিতৃপরিবার এই দায় থেকে এক ধরনের মুক্তি নিয়ে নেয়, ফলে নতুন করে সেই দায় নিতে রাজী থাকে না। দ্বিতীয়ত, সন্তানের অভিভাবকত্ব। বাংলাদেশে বিয়ে, বিয়েবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব এবং সম্পদে অধিকারের মত বিষয়গুলো চলে পারিবারিক আইনের কাঠামোতে। নারীর অধিকার কেবল সন্তানের জন্মদান এবং লালন-পালনে, নারী তার সন্তানের বৈধ অভিভাবক নয়, অভিভাবক সন্তানের পিতা । সেদিক থেকেও নারী অসুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। সন্তানের মুখ চেয়েও তাই নারীকে নিপীড়ক স্বামীর সংসার করে যেতে হয়। কাজেই রাষ্ট্র যতদিন এই বৈষম্যমূলক আইনগুলো পরিবর্তন না করবে বা রাষ্ট্রকে বাধ্য না করানো যাবে, যা আসলে ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কার, ততোদিন পর্যন্ত ধর্মের নামে, সমাজের নামে, লোকলজ্জার নামে নারীর বিরুদ্ধে এই সহিংসতা থেকে মুক্তি আশা করা দুঃসাধ্য। একটি নিরাপদ রাষ্ট্র যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই নিরাপদ, যেখানে লিমনও নিরাপদ, নারী সাংসদ কবরীও নিরাপদ, সেই রাষ্ট্রে তো সন্তানের নিরাপত্তার জন্য রুমানাদের কারো উপর নির্ভর করতে হবে না। পুরুষের উপর নারীর এই নির্ভরশীলতার অন্তর্গত রাজনীতি থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করতে হলে যে পাল্টা রাজনীতি প্রয়োজন, সেই রাজনীতিতে সামিল হওয়া চাই।
যে ‘ভালো মেয়ে’র সনদ কিনতে হয় নিজের সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে, নিজের অঙ্গহানি নয়তো জীবন দিয়ে, মেয়েদের সময় এসেছে পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেয়া এসব ভালো মেয়ের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে মানুষ হিসাবে নিজের দাবি নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার। যে কোন দামে বিয়ে টিকিয়ে রাখার বিপরীতে নারীর বিয়ে-নিরপেক্ষ মানবিক অবস্থানটি প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। অন্তত নিজের চোখদু’টি তো রক্ষা করতে পারা চাই, নয়তো কীসের জীবন? তবে সমাজের প্রচলিত অনুভব কাঠামো এবং রাজনীতির বিপরীতে দাঁড়ানো খুব সুখের হবে না, হয়নি কখনো তবু মানুষের চলার বেগেই পায়ের তলায় রাস্তা জাগে। আবেদন-নিবেদনের উন্নয়ন মডেল থেকে বের হয়ে জীবনের দায়িত্ব নেবার রাজনীতিটি বুঝে নেবার এইটাই মাহেন্দ্রক্ষণ। যে সামষ্টিক অন্ধত্ব এবং আপোষ রুমানার চোখের আলো কেড়ে নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কোন বিকল্প নেই।

২১ জুন ২০১১

ড. কাবেরী গায়েন: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।